Nataisuto

চাঁদপুরের চার জমিদার বাড়ি, চারশো বছরের পুরনো মঠ, শত বছরের প্রাচীন মসজিদ, তিন নদীর মোহনার ভ্রমন বৃত্তান্ত।



চাঁদপুরে ভ্রমণে সাধারণত আমরা রাতের লঞ্চে ভ্রমণে গিয়ে সকালে চাঁদপুরের আশপাশ ঘুরে চলে আসি। কিন্তু চাঁদপুরে একদিনের ভ্রমণে অনেককিছুই আমরা ঘুরতে পারি।  আমরা তেমনই দিয়েছিলাম এক দিনের চাঁদপুর ভ্রমণ।
সবমিলিয়ে খরচ পড়েছে মাত্র ৮০০ টাকা।
.
এই প্ল্যানে আমরা যা দেখেছি এবং আপনি যা দেখবেন
রূপসা জমিদার বাড়ি, শোল্লা রাজবাড়ি, লোহাগড়া মঠ, বড়কূল জমিদার বাড়ি, বলাখাল জমিদার বাড়ি।
সঙ্গে শহরের তিন নদীর মোহনা ও হাজীগঞ্জ বড় জামে মসজিদ ও লঞ্চ ভ্রমণ ফ্রি।
.
যেভাবে দেখবেন- প্রথমে ঢাকা থেকে চাঁদপুরের রাত সাড়ে বারোটার লঞ্চে উঠে পড়ুন। সোজা লঞ্চের ছাদে চলে যাবেন। জোসনা রাত হলে তো খাপে খাপ, অন্যদিন হলেও সমস্যা নেই। বাকিরাত টুকু রাতের নিস্তব্ধ নদী আর আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকুন তারাভরা আকাশ।

ভোরে লঞ্চ থেকে নেমে নাস্তা করে চলে যাবেন চাঁদপুর বড় স্টেশন। এখান থেকে নৌকায় উঠে নদীতে দেখবেন তিন নদীর মোহনা। দুই দিকে স্রোতের আকৃতি ভিন্ন।
ফিরে আসুন এবার। চলে আসুন বাস স্ট্যান্ডে। উঠে পড়ুন ফরিদগঞ্জ উপজেলার বাসে। ফরিদগঞ্জ এসে রোডের বাঁ পাশে রূপসা বাজারের লোকাল সিএনজি পাবেন। সিএনজি জমিদার বাড়ির গেইটের পাশেই নামিয়ে দিবে।
.

বাংলাদেশের জমিদারদের জন্য এক আদর্শের নাম রূপসার
জমিদার।
এখন থেকে প্রায় আড়াইশ’ বছর পূর্বে রূপসার খাজুরিয়া এলাকা সিংগেরগাঁও নামে পরিচিতি ছিলো। সেখানে বাইশ সিংহ পরিবার নামে এক হিন্দু পরিবার বসবাস করতো। সেই সিংহ পরিবারের জমিদারির পরিসমাপ্তি ঘটলে আহম্মদ রাজা চৌধুরী রূপসা জমিদার বাড়িতে জমিদারি শুরু করেন। মোহাম্মদ গাজী চৌধুরী ছিলেন দানশীল ব্যক্তি। মোহাম্মদ গাজী চৌধুরী রূপসায় জমিদারির সময়ে এলাকার অসহায়দেরকে নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। তার মৃত্যুর পর রূপসার জমিদারি ভার গ্রহণ করেন তারই পুত্র আহমেদ গাজী চৌধুরী। রূপসা জমিদার বাড়ির সামনেই আছে শতাব্দী প্রাচীন মসজিদ। মসজিদের চূড়া এককথায় অপরূপ।
.
রূপসা জমিদার বাড়ি দেখে ফের সিএনজিতে যাবেন শাল্লা রাজবাড়িতে। এটাও ফরিদগঞ্জেই। তবে রূপসা থেকে কাছে। শাল্লা বাজারেই। সেখান থেকে ফিরে আসুন ফরিদগঞ্জ বাজারে। টমটমে উঠে আউয়ালের মিষ্টির দোকানে এসে নামাতে বলুন। দোকানের নাম আউয়াল সুইটস। এক মিষ্টি খেয়ে চোখ বন্ধ করে বলবেন দেন, আর বিল দেয়ার সময় খেয়াল করবেন, কোন ফাঁকে খেয়ে ফেলেছেন দশটা আস্ত! ফরিদগঞ্জ গিয়ে আউয়ালের মিষ্টি না খাওয়া মানে মহাপাপ করা। এবার মূল সড়কি এসে উঠে পড়ুন লোহাগড়া মঠের দিকে।
.
প্রায় চার শতাব্দী পুরাতন প্রাচীন এই মঠ ফরিদগঞ্জ উপজেলার লোহাগড় গ্রামে ডাকাতিয়া নদীর পাশে অবস্থিত।
লোহাগড় গ্রামের লোহাগড় মঠ লৌহ এবং গড় নামে দুজন জমিদারের নামানুসারে এলাকাটির নাম রাখা হয় লোহাগড়। জমিদারদের নামানুসারে গ্রামের সাথে মিল রেখেই তাদের স্থাপত্যশৈলিরও নাম রাখা হয় লোহাগড় মঠ।
.
মঠ দেখে এবার ফিরে আসুন মূল রাস্তায়। ফের চাঁদপুর শহরে যাবেন না। নামবেন ওয়ারল্যাস মোড়ে। ওখান থেকে উঠবেন হাজীগঞ্জের বাসে। এবং নামবেন বলাখাল বাজারে। হাতের ডানপাশে হেঁটে ঢুকবেন জমিদার বাড়িতে। এই জমিদার বাড়ির একাংশ এখন ভঙ্গুর। যদিও তা খুব নগন্য অংশ। বাড়ির একপাশে জমিদারের বংশধর থাকেন, অন্যপাশ লাকড়ি রাখার কাজে। স্তব্ধ হয়ে যাবেন ফটকের গায়ের নিপুণ কারুকার্যে। এই বাড়ির ঢোকার সময় পাবেন সূপ্রাচীন ঘাট সমেত পুকুর যদিও ঘাট এখন ভেঙ্গে অনেকটাই বিলুপ্ত।
সুরেন্দ্র নারায়ন রায় চৌধুরী ও দেবেন্দ্র নারায়ন রায় চৌধুরী তাদের পিতা - যোগেন্দ্র নারায়ন রায় চৌধুরী ছিলেন বলাখাল এস্টেটের জমিদার।
.
এবার ফিরে আসুন হাজীগঞ্জ বাজারে। হাজীগঞ্জ বাজারেই দেশের অন্যতম বৃহত্তম জামে মসজিদ "হাজীগঞ্জ জামে মসজিদ"। বাংলা একাদশ শতকের কাছাকাছি সময়ে হযরত মকিম উদ্দিন (রঃ) নামে এক বুজুর্গ অলীয়ে কামেল ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আরব ভূমি হতে স্ব-পরিবারে চাঁদপুরের বর্তমান হাজীগঞ্জ অঞ্চলে আসেন। পরবর্তীতে তারই বংশধর হাজী মুনিরম্নদ্দিন (মনাই গাজী) এর প্র-পৌত্র হাজী আহমদ আলী পাটোয়ারী (রঃ) হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক জামে মসজিদের জন্য জায়গা ওয়াকফ করে মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন।
.
মসজিদ দেখে সোজা চলে যান হাজীগঞ্জ বাজারের পপুলার হাসপাতালের সামনে। এখান থেকে বড়কূল বাজারের সিএনজি।
বাজারের সামনের দিকে দেখতে পাবেন দিঘি। দিঘির পেরিয়ে একটু হাঁটলেই বড়কূল জমিদার বাড়ি।
.
মুক্তিযুদ্বের স্মৃতিবিজড়িত বড়কূল জমিদার বাড়ি। ১৯৭১ পাকহানাদার বাহিনী বাড়িটি পুড়িয়ে দেয়। কিন্তু এখনো বাড়িটি আছে অবহেলার নিদর্শন হয়ে। গোটা বাংলাদেশে আয়তনে সর্ব বৃহত্তম জমিদার বাড়িগুলোর একটি বড়কূল জমিদার বাড়ি। এই জমিদার বাড়িতে মোট পাঁচটি স্থাপনা। ছিলো সাতটি। বাকি দুটো অবহেলায় এখন কেবল ইটের দেয়াল ছাড়া কিছুই নেই। এতোখানি অবহেলা বোধহয় আর কোন জমিদার বাড়িতে হয়নি! বাড়িটিকে স্থানীয়রা চিনে
ভাগিত্যা বাড়ি বলে। ভাগিত্যা মানে ভাগ্যবানের বাড়ি। মালিক ছিলেন জমিদার পদ্মলোচন সাহা।
বড়কুল গ্রামে আরো আছে পোদ্দারবাড়ি ও
রাধেশ্যাম সাহার বাড়ি। দেখতে পারেন এই বাড়ি গুলোও।
.
ফিরে আসুন হাজিগঞ্জ হয়ে চাঁদপুর শহরে। কাউকে বললেই চিনিয়ে দিবে কালীবাড়ি মোড়। আরেক অসাধারণ খাবারের দোকান। নাম ওয়ান মিনিট। এদের আইসক্রিম খুব বিখ্যাত, তবে দধি ও মিষ্টি খেয়ে দেখতে পারেন। পুরোই পয়সা উসুল হবে!
.
এবার ফিরে আসুন লঞ্চ ঘাটে, ঢাকায় ফেরার পালা। ব্যস্ততম ভ্রমণের দিনশেষে ক্লান্তিকর বুজে আসবে চোখ, কিন্তু আপনি জানেন এ প্রশান্তিতে! আর রাতের শেষ লঞ্চে ফিরতে চাইলে আসুন বড় স্টেশনের তিন নদীর মোহনার তীরে! প্রান্তর ভেজানো জোসনা কিংবা তারা ভরা আকাশ দেখে নিমেষেই মনের অজান্তেই বলে উঠবেন, "বাহ জীবনটা কি অপূর্ব সুন্দর"!
.
যেভাবে যাবেন- ঢাকা থেকে লঞ্চে চাঁদপুর।
.
বি:দ্র:- প্রকৃতি ও পুরাকীর্তি আমাদের সম্পদ। দয়া করে পুরাকীর্তির গায়ে আঘাত করবেন না, প্রকৃতিতে যত্রতত্র অপচনশীল ময়লা ফেলবেন না। আপনি যেমন সৌন্দর্য উপভোগ করছেন, আপনার পরবর্তী প্রজন্ম যেন অধিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে।
full credit by ahamed estiak.

Post a Comment

0 Comments