কংলাক পাড়ায় নবনির্মিত একটি গির্জায় গিয়ে জানালার পাশে চুপ করে বসে রইলাম। দু'জন ভদ্র মহিলা প্রার্থনা সঙ্গীত চর্চা করছেন। পাশেই একজন সে মোহনীয় সুরের সাথে ইন্সট্রুমেন্ট বাজাচ্ছে। মনে হল এখানে চুপচাপ বসে থাকা যায়। জানালার পাশেই কংলাক আর লুসাই পাহাড়ের মাঝের উপত্যকায় মেঘ জমে আছে। আমার হাতে দুটো বই। এদের কোন একটাকে নিয়ে জানলার পাশে বসে যাওয়ার যথার্থ জায়গাই এটা।
হুমায়ূন আহমেদের 'নীল অপরাজিতা' নিয়ে বসে পড়লাম গির্জার লম্বাটে বেঞ্চে। কখনো বইয়ে ডুব দেই কখনো জানালার ওপাশের পৃথিবীতে। সূর্যের উত্তাপে মেঘগুলো কেমন অস্থির হয়ে উঠছে। উপত্যকার মায়া কাটিয়ে তারা শূন্যে ভাসবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমন দৃশ্যের ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে মোহনীয় প্রার্থনা সংগীত। প্রিয় লেখকের উপন্যাস পড়ার জন্য এমন চমৎকার পরিবেশ আর কি হতে পারে?
যেই শুনে একা সাজেকে এসেছি, সেই বেশ অবাক হয়। তাদের বিস্মিত হবার পরিধিটা আরো বাড়ে আমার হাতে বই দেখে। আমিও স্মিত হেসে উত্তর দেই, 'একা কই, বই তো আমার সঙ্গী।'
প্রথম দিন সাজেক নেমে রুম ঠিক করতে গেলাম। একজন তো রুম ভাড়া কত চাইবে দ্বিধায় পড়ে গেল।
উনার শরমিন্দা চেহারা দেখে বললাম 'ভাই আমার বাজেট অনেক কম।'
সে বলল, 'একা থাকবেন আপনার কাছে কত চাইব বুঝতেছি না।'
খেতে গিয়ে শুনি অর্ডার না করলে খাবার হবে না। বললাম, 'একা তো।'
বলল, 'ওহ তাহলে আমাদের সাথেই খেয়ে নিয়েন।'
বললাম, 'যা আছে দেন, ভীষণ খিদে পাইছে।'
ঐ হোটেলের মেন্যু সব অর্ডার করা ছিল। যাক পরে দুই পদ সবজি দিয়ে ভাত দিল। আর কিছু দিতে পারছে না। স্থানীয় একজন এসে বলল, ঐ ট্রাভেলারকে বদা ভেজে দাও। আমার চোখ কপালে। কি কয়? পরে বুঝলাম বদা মানে ডিম।
আমি ভয়াবহ রকম ঝাল দুই টাইপের সবজি আর বদা দিয়ে নাকের পানি চোখের পানি এক করে দুপুরের খাবার সারলাম। এই ট্রিপেই প্রথম কেউ ট্রাভেলার বলে সম্ভোধন করেছিল। ;)
সাজেকে ২য় দিন সকাল। রাস্তার দু'পাশে মেঘ, মেঘ আর মেঘ। সবুজ পাহাড় ডুবে আছে দুধ রং মেঘে। কটেজের ফাঁক ফোকর দিয়ে মেঘ দেখা যায়। আমি উঁকি-বুঁকি দিয়ে মেঘ দেখি আর হাঁটি। কিউট একটা বাচ্চা মেয়েকে পাশে পেয়ে বললাম, 'বাবু, আমাকে একটা ছবি তুলে দিবা?'
সে বলল, '১০ টাকা দিলে তুলে দিব।'
বললাম, 'টাকা দিতে পারব না। আমি গরীব। দাও না তুলে?'
বিনিময়ে সে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে চলে গেল আর আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা মাচাংয়ে পা ঝুলিয়ে বসে পড়লাম। এদের এমন কে বানাল?
সাজেক জিরো পয়েন্টে মোবাইল উল্টা করে সেলফি তুলতেছিলাম। কারন ফ্রন্ট ক্যামেরা কাজ করে না। এক ছাত্র নেতা এসে বলল, 'একা একা বই নিয়ে ঘুরতেছেন। আপনি হুজুরের কটেজে উঠছেন না?'
বললাম, হ্যাঁ।
'একাই আসছেন শুনলাম।'
বললাম, 'হ্যাঁ।'
বলল, 'আমি সাজেকের অমুক তমুক, সমস্যা-টমস্যা হলে বইলেন।'
ফেরার দিন একটা গ্রুপ অফার করল, চাইলে আমাদের সাথে ফিরতে পারেন। এদিকে ফেরার জন্য আমাকে আবার বাইক খুঁজতে হত। এমন অফার পেয়ে কে যায় খোঁজাখুঁজির ঝামেলায়? ফেরাটা হয়েছিল উনাদের সাথেই।
আমি যে কটেজে ছিলাম সেটার মালিক বলল, রুমটা আরেকজন কে না দিয়ে একটু লস করে আমাকে দিয়েছিলেন। কারন সে আমার কথায় নাকি ইমপ্রেজড!
রুম ভাড়া নিয়ে বারগেইনিং করার সময় আমি বলেছিলাম, আপনার রুমের চেয়ে কমে আমি রুম পেয়েছিলাম। কিন্তু আপনার কটেজের বারান্দাটা আমার পছন্দ হয়েছে। এখানে বসে আমি মেঘ দেখব আর বই পড়ব। আমার ব্যাগটা দেখছেন না, এর অর্ধেকটাই বইয়ে ভরা।'
বেচারার শুরুতে মন না গললেও আধা ঘন্টা পড়ে আমাকে কল দিয়েছিল। বলেছিল, 'ভাতিজা তুমি আমার এখানেই থাকবা।'
এই ৪ রাত ৩ দিনের ট্রিপের বাজেট ছিল ৫ হাজার। বাসায় এসে দেখি খরচ হয়েছে ৩৭০০ এর মত। যাক বেঁচে যাওয়া টাকায় আরেকটা ট্যুর তো করা যাবে। ;)
................................................................................
ছবিঃ চার্চের জানালা থেকে, কংলাক পাড়া।
রুট প্ল্যানঃ ঢাকা-দীঘিনালাঃ শান্তি পরিবহন (৫৮০)
দীঘিনালা-সাজেকঃ শেয়ার্ড সিএনজি (৪৫০)
দীঘিনালা-খাগড়াছড়িঃ লোকাল চান্দের গাড়ি (৫০)
খাগড়াছড়ি-চট্টগ্রামঃ শান্তি পরিবহন (১৯০)
চট্টগ্রাম-ঢাকাঃ তূর্না এক্সপ্রেস (৩৬৫/online)
সাজেকঃ The Land of Whispering Clouds
০৫-০৯ নভেম্বর ২০১৭
লিখকঃ রফিকুল ইসলাম।
0 Comments