Nataisuto

আরে আপা, বুঝলা না, স্বাধীন বাংলাদেশের হয়া ওপেনিং করুম দেইখাই তো পাকিস্তান ভাইঙ্গা দিতাছি।


সেই যে একটা ছেলে ছিল, রাজপুত্রের মত ফুটফুটে দেখতে, ঠোটের কোনায় সবসময় এক চিলতে হাসি লেগেই থাকতো। রসিকতার জাহাজ ছিল ছেলেটা। ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি উইকেট কিপিংটাও করত চমৎকার, মাঠ মাতিয়ে রাখতো সবসময়। জন্মরসিক ছিল ছেলেটা। একটা জুটি দাঁড়িয়ে গেছে, উইকেট পড়ছে না, দেখা গেল উইকেটের পিছে দাঁড়িয়েই বান্দা একের পর এক রসিকতা করে যাচ্ছে। বেচারা ব্যাটসম্যান খেলবে কি, হাসতে হাসতেই আউট… কি বিপদ, দেখো তো… দুর্ধর্ষ মারকুটে ব্যাটসম্যান ছিল ছেলেটা, ব্যাট হাতে মাঠে নামার পর বোলারদের নাকের জল চোখের জল এক হয়ে যেত। আজাদ বয়েজ ক্লাবের হয়ে ওপেনিংয়ে নামতো, ৪৫ ওভারের ম্যাচ। টর্নেডো বইয়ে দিত একেবারে, ধুমধাড়াক্কা বাইড়ানির চোটে বিপক্ষ দল চোখে অন্ধকার দেখত, নাকের জল-চোখের জল এক হয়ে যেত বোলারদের, বলের লাইন-লেন্থ কোথায় উড়ে যেতো ! স্লগ সুইপটা অসাধারণ খেলত, বল জিনিসটা যে পেটানোর জন্য, এইটার সবচেয়ে বড় উদাহরন ছিল ওর ব্যাটিং। করাচীর লীগের এক ম্যাচে একদিন ওর তুমুল মার দেখতে দেখতে এক পাঞ্জাবী কোচ সবিস্ময়ে বলে উঠলো, এই ছেলে এইখানে কেন? ওর তো ন্যাশনাল টিমের হয়ে ওপেনিং করার কথা… কথাটা খুব সত্য ছিল, কিন্তু অবাস্তব সত্য। ছেলেটা বাঙ্গালী, আর পাকিস্তান নামক এই পোকায় কাটায় রাষ্ট্রটায় বাঙ্গালীর অবস্থান ছিল কুকুরের চেয়েও নিকৃষ্ট, গোলামেরও চেয়েও অধম। ছেলেটার স্বপ্ন ছিল আকাশছোঁয়া, ছেলেটা ন্যাশনাল টিমের হয়ে ওপেনিং করার স্বপ্ন দেখতো। স্বাধীন বাংলাদেশ দলের ওপেনিং করবার স্বপ্ন… ১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চ জেলা ক্রীড়া ভবনের সামনে সদা হাস্যজ্বল মুশতাক ভাইয়ের দু হাত উপরে তলা ডেডবডিটা পড়ে ত্থাকতে দেখার পর ছেলেটার স্বপ্নটা একটা ধাক্কা খেল। নিষ্প্রাণ ঝাঁজরা দেহটা পড়ে আছে খোলা আকাশের নিচে। হাতদুটো উপরে ধরা। আজাদ বয়েজ ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা মুশতাক ভাইয়ের আপন শত্রুও এই অপবাদ দিতে পারবে না যে, তিনি কাউকে কোনোদিন একটা গালি দিয়েছেন। ক্রিকেট ছিল তার ধ্যান, একমাত্র সাধনা। বিনা অপরাধে এভাবে মরতে হবে, মৃত্যুর আগ মুহূর্তেও হয়তো এটা তার কল্পনাতেও ছিল না। মুশতাক ভাইয়ের সেই দৃষ্টি ছেলেটার মাথায় গেঁথে গেল, ব্যাট ফেলে তুলে নিল স্টেনগান, পাকিগুলারে মারতে হবে, দেশটাকে স্বাধীন করতে হবে… প্রথমে বাধা হয়ে এসেছিল স্নেহময়ী মা। ছোটবেলা থেকে যক্ষের ধনের মত আগলে রাখা মায়ের চোখকে ফাকি দিয়ে মে’র ৩১ তারিখ বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায় ছেলেটা। প্রতিপক্ষের বোলারদের এতটুকু চড়াও হতে না দেওয়ার মানসিকতা যার, অ্যাটাক ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স ছিল যার মুলমন্ত্র, সে কিভাবে নিজেকে ঘরে আটকে রাখবে? তাই দেশমাতা সম্ভ্রম রক্ষায় বেরিয়ে গিয়েছিল ও, যাবার কদিন আগে মাকে একটা চিঠি দিয়ে বলেছিল, “আমি যখন থাকবো না, এই ছবিটাতে তুমি আমাকে দেখতে পাবে।” দুই নম্বর সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল খালেদ মোশাররফের নির্দেশে গেরিলা ওয়ারফেয়ারের কিংবদন্তী মেজর এটিএম হায়দার ১৭ জন তরুণকে গেরিলাযুদ্ধের ট্রেনিং দিয়ে ঢাকায় অপারেশনে পাঠান। এরাই পরবর্তীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অকল্পনীয় ত্রাস “ক্র্যাকপ্লাটুন”-এ পরিণত হয়। ছেলেটা এই ১৭ জনেরই একজন ছিল। সিদ্ধিরগঞ্জ অপারেশনের রেকি করতে গিয়ে রামপুরা বিলে পাকিস্তানি সেনাদের ব্রাশফায়ারে ডান হাতের তিনটা আঙ্গুল ভেঙ্গে গর্ত হয়ে গিয়েছিল ছেলেটার (পড়ুন- সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্র: জুয়েলের শেষ অপারেশন)। হাতটাকে পচনের হাত থেকে বাঁচাতে আঙ্গুলগুলা কেটে ফেলতে হবে, হঠাৎ ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে করুন স্বরে আর্তি জানাল ছেলেটা, “দেশ স্বাধীন হইলে আমি ন্যাশনাল টিমের হইয়া ওপেনিংয়ে নামুম, ক্যাপ্টেন হমু। আঙ্গুল তিনটা রাইখেন স্যার, প্লিজ…” ডাক্তার ছেলেটার স্বপ্নটা ভেঙ্গে দেন নাই। আঙ্গুল তিনটা রেখেছিলেন। খুব অস্থির হয়ে যেত ছেলেটা মাঝে মাঝে। আঙ্গুলগুলোর দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ চেহারায় কি যেন ভাবতো। সহযোদ্ধা আলমের ছোটবোন পুলু যখন ছেলেটার ভাঙ্গা আঙ্গুল তিনটা ড্রেসিং করতো, তখন প্রচণ্ড যন্ত্রণা লুকিয়ে হাসতে হাসতে ওর আপাকে ছেলেটা বলতো, আরে আপা, বুঝলা না, স্বাধীন বাংলাদেশের হয়া ওপেনিং করুম দেইখাই তো পাকিস্তান ভাইঙ্গা দিতাছি। খালি স্বাধীন বাংলাদেশটা হইতে দে, দেখবি ক্যামনে পাইক্কাগুলারে হারাই। ওপেন করতে নাইমা পিটাইতে থাকুম, পিটাইতে পিটাইতে ছাল বাকলা তুইলা ফেলুম। শালার আঙ্গুল তিনটায় গুলি না লাগলেই আর সমস্যা হইত না। কবে যে ভালো হইব কচু, কবে যে ব্যাট ধরতে পারুম… ২৯ শে আগস্ট ছেলেটা মগবাজারে আজাদের বাসা থেকে ধরা পড়ে। ধরা পড়ার সময়ও ছেলেটার বুকের গহীনে সেই আকাশছোঁয়া স্বপ্নটা ছিল, দেশের হয়ে ওপেনিংয়ে ব্যাট করার স্বপ্ন, স্বপ্নটার মধ্যেই বাস করতো ছেলেটা। ধরে নিয়ে যাবার সময় আজাদদের বাসায় ছেলেটার ভাঙ্গা আঙ্গুল তিনটা ধরে যখন মোচড় দিচ্ছিল পাকি ক্যাপ্টেন, তখনো স্বপ্নটা ছেলেটাকে ঘিরে ছিল। টর্চার সেলে আঙ্গুলগুলোর উপর হাতুড়ির বাড়ি পড়তো প্রতিদিন নিয়ম করে, প্ল্যায়ার্স দিয়ে মুচড়ে ধরে জিজ্ঞেস করতো এই নরাধমগুলো, “মুক্তি কা রুট কিধার হ্যায়, হাতিয়ার কাহা সে আ রাহা,” তখনো স্বপ্নটা ছেলেটাকে ছেড়ে যায়নি। স্বপ্নটাকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছিল ছেলেটা… জীবনের শেষ ইনিংসে ছেলেটা অপরাজিত ছিল, অপরাজিত ছিল তিনটা আঙ্গুল ভেঙ্গে যাওয়ার পরেও। ভাঙ্গা আঙ্গুল তিনটা বুটের নিচে পিষে ফেলার সময় অমানুষিক যন্ত্রণা হচ্ছিল, কিন্তু ছেলেটা হেরে যায়নি। ‘কাহা সে ট্রেনিং লেকে আতা তুম লোগনে, কিধার সে আর্মস আতা’- প্রশ্নগুলো সহস্রবার করেছে পাকি হায়েনারা, উত্তর না পেয়ে আঙ্গুলের পর বেয়নেট দিয়ে একটু একটু করে ফালা ফালা করেছে ছেলেটার শরীরটা, ছেলেটা হেরে যায়নি। চিৎকার করেছে, যন্ত্রণায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে, মাকে ডেকেছে আকুতিভরে, তবুও একটা কথাও বলেনি সে। তার সহযোদ্ধাদের পরিচয়, অস্ত্রের চালান কিংবা ট্রেনিংয়ের রুট, কিছুই বলেনি। নিশ্চিত মৃত্যুর সামনেও অপরাজিত ছিল ছেলেটা, মাথা উঁচু করে, বুকটা ফুলিয়ে, হেরে যাওয়াটা যে তার অভিধানে ছিল না… ছেলেটার স্বপ্নটা পূরণ হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশের হয়ে ওপেনিং নেমে পাকিস্তানীদের নাকের জল চোখের জল এক করে দেওয়া আর হয়নি। ৩০ লাখ শহীদের একজন হয়ে ছেলেটা মিশে গেছে এই জমিনে, ঠিক যে জমিনের উপর দাড়িয়ে আছি আমরা, ঠিক যে জমিনের উপর দাড়িয়ে পাকিস্তান জিন্দাবাদ শ্লোগান দেয় এই প্রজন্মের কিছু সন্তান। ছেলেটার নাম জুয়েল, এই প্রজন্মের বেশিরভাগের কাছে অবশ্য ছেলেটা ধুলাপড়া অতীত মাত্র… ছেলেটা আর ফিরে আসেনি, স্বাধীন বাঙলাদেশের হয়ে ওপেনিং করার স্বপ্ন দেখতো যে ছেলেটা, সে আর ফিরে আসেনি। হাসিখুশি সেই রাজপুত্রটার স্বপ্নটা পূরণ হয়নি, স্বপ্নটা যে সে উৎসর্গ করেছিল একটা স্বাধীন দেশের জন্য, একটা লাল-সবুজ পতাকার জন্য… পাকিস্তান সমর্থন করার সময়, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের টিটকারী দেওয়ার সময় আর অপমান করার সময় জুয়েলদের আত্মত্যাগের কথা কি একবারও মনে পড়ে আমাদের? একবারও কি টের পাই তাদের যন্ত্রণাটা?

Post a Comment

0 Comments